লোহার দৈত্যের মজার গল্প: ভারতের প্রথম ট্রেন
যাত্রা ১৬ এপ্রিল, ১৮৫৩। বোম্বে থেকে থানে, মাত্র ৩৪ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে ভারতের প্রথম যাত্রীবাহী ট্রেন ইতিহাসের পাতায় নাম লেখায়। এই “আগুনের গাড়ি” শুধু লোহা আর কয়লার যন্ত্র ছিল না, এটি ছিল বিস্ময়, হাসি, আর কৌতূহলের এক উৎসব! স্থানীয় মানুষের মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়া মজার গল্পগুলো আজও আমাদের হাসায় আর ট্রেনের প্রথম দিনের উত্তেজনা ফিরিয়ে আনে। চলুন, এই লোহার দৈত্যের কিছু হাস্যকর আর চমকপ্রদ গল্পে ডুব দিই!
গোবর দিয়ে ট্রেন চলে?
ট্রেনের উদ্বোধনের দিন বোম্বের কাছে এক গ্রামের মানুষ ভেবেছিল, এত বড় লোহার যন্ত্র চালাতে নিশ্চয়ই গরু-ছাগলের গোবর দিয়ে আগুন জ্বালানো হয়! একদল গ্রামবাসী স্টেশনে হাজির হয়ে রেল কর্মকর্তাদের জিজ্ঞাসা করে বসল, “এই ট্রেন চালাতে কত গোবর লাগে?” কর্মকর্তারা হেসে ফেললেন আর বললেন, “গোবর নয়, এটা কয়লায় চলে!” গ্রামের লোকেরা মুখ চাওয়াচাওয়ি করে হাসতে লাগল, আর একজন বলে উঠল, “তাহলে আমাদের গরুগুলো কাজে লাগল না!” এই গল্প ছড়িয়ে পড়ে, আর গ্রামে গ্রামে হাসির ঝড় ওঠে।দৈত্যের পেটে ভ্রমণথানের কাছে এক গ্রামের বৃদ্ধা তার ছেলেকে বারণ করেছিলেন, “ওই লোহার দৈত্য মানুষ গিলে ফেলে, ট্রেনের কাছে যাস না!” কিন্তু ছেলেটি, নাম ধরা যাক রামু, কৌতূহলী ছিল। সে লুকিয়ে বোরি বান্দার স্টেশনে গিয়ে তৃতীয় শ্রেণির কামরায় উঠে পড়ল। ট্রেন ছাড়ার সময় শিসের শব্দ আর ঝাঁকুনিতে রামু ভয়ে চোখ বন্ধ করে ভাবল, “এবার গিলে ফেলল!” কিন্তু জানালা দিয়ে গাছ-মাঠ ছুটে যেতে দেখে তার ভয় কেটে গেল। থানে পৌঁছে সে গ্রামে ফিরে চিৎকার করে বলল, “আমি দৈত্যের পেটে বসে থানে গিয়ে ফিরলাম!” গ্রামের মানুষ হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খেল, আর রামুর গল্প শুনে অনেকে ট্রেনে চড়ার সাহস পেল।
ট্রেনের সঙ্গে দৌড়
এক তরুণ ভেবেছিল, ট্রেন বুঝি ঘোড়ার মতো একটু দৌড়ে থেমে যায়। তাই উদ্বোধনের দিন সে ঠিক করল, সে ট্রেনের সঙ্গে দৌড়ে থানে পৌঁছে যাবে! ট্রেন যখন বোম্বে থেকে ছাড়ল, সে রেললাইনের পাশ দিয়ে জোরে দৌড় শুরু করল। ভিড় থেকে হাসি আর চিৎকার উঠল, “দেখো, লোকটা ট্রেনের সঙ্গে পাল্লা দিচ্ছে!” কিন্তু ট্রেন গতি বাড়াতেই গোপাল ধোঁয়া আর ধুলোয় হাঁপিয়ে পড়ে গেল। ফিরে এসে সে হাসতে হাসতে বলল, “এটা ঘোড়া নয়, দেবতার গাড়ি!” তার এই দৌড়ের গল্প এত জনপ্রিয় হলো যে গ্রামে গ্রামে লোকে তাকে “ট্রেন-দৌড়ে পাগোল” বলে ডাকতে লাগল।
পূজা দিয়ে ট্রেন থামানো
থানের কাছে এক গ্রামে গুজব ছড়িয়েছিল, ট্রেন নাকি একবার চলতে শুরু করলে আর থামে না—শুধু দেবতার কৃপায় থামানো যায়! গ্রামের এক পুরোহিত ঠিক করলেন, ট্রেন যখন থানে পৌঁছাবে, তিনি রেললাইনের পাশে পূজা করে এটিকে থামাবেন। ফুল, ধূপ, আর নৈবেদ্য নিয়ে তিনি পূজার আসন পেতে বসলেন। ট্রেন ঠিক সময়ে নিরাপদে থামল, আর পুরোহিত চিৎকার করে বললেন, “আমার পূজায় অগ্নিদেব ট্রেন থামিয়েছেন!” গ্রামবাসীরা এতটাই বিশ্বাস করল যে কয়েক সপ্তাহ ধরে রেললাইনের কাছে ফুল ছড়িয়ে পূজা চলতে লাগল। কেউ কেউ ইঞ্জিনকে “শিবের বাহন” বলে ডাকত, কারণ এটি ধোঁয়া ছড়িয়ে ছুটত!
জানালায় উড়ন্ত গ্রাম!
প্রথম ট্রেনের যাত্রীরা জানালা দিয়ে বাইরের দৃশ্য দেখে এত অবাক হয়েছিল যে অনেকে ভেবেছিল, গ্রাম-মাঠ সব যেন উড়ে যাচ্ছে! এক যাত্রী তার বন্ধুকে বলল, “দেখ, গ্রামগুলো আমাদের পেছনে ছুটছে!” বন্ধুটি হেসে বলল, “বোকা, আমরাই ছুটছি!” কামরায় হাসির ঝড় উঠল। আরেকজন এত উত্তেজিত হলেন যে জানালা থেকে হাত বের করে হাওয়া ধরার চেষ্টা করলেন, আর বললেন, “এ যে আকাশে উড়ার মতো!” কেউ কেউ গান গাইতে শুরু করল, যেন ট্রেনে চড়া একটা উৎসব।
ট্রেনে চড়লে জাত যায়
ভয়স্থানীয়দের মধ্যে কিছু রক্ষণশীল গোষ্ঠী ট্রেনকে সন্দেহের চোখে দেখেছিল। তৎকালীন ভারতীয় সমাজে জাতপাতের বিভেদ ছিল প্রকট, আর ট্রেনের কামরায় বিভিন্ন জাতি ও সম্প্রদায়ের মানুষের একসঙ্গে বসার বিষয়টি অনেকের কাছে অগ্রহণযোগ্য মনে হয়েছিল। বোম্বের কাছে একটি গ্রামে একদল পণ্ডিত ঘোষণা করেছিলেন যে “ট্রেনে চড়লে জাত যায়”, কারণ এটি “বিদেশি মেশিন” এবং এতে বিভিন্ন জাতের মানুষ একসঙ্গে মিশে যায়।
একটি গল্পে বলা হয়, একজন ব্রাহ্মণ ব্যক্তি ট্রেনে চড়তে চাননি, কিন্তু তার ব্যবসায়িক কাজের জন্য তাকে থানে যেতে হয়েছিল। অনেক দ্বিধার পর তিনি তৃতীয় শ্রেণির কামরায় উঠলেন, কিন্তু পুরো যাত্রায় তিনি এক কোণে বসে মন্ত্র পড়তে থাকলেন, যেন তার “জাত” রক্ষা পায়। ট্রেন থানে পৌঁছানোর পর তিনি দ্রুত গঙ্গাজল দিয়ে স্নান করে নিজেকে “পবিত্র” করেন। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো, পরে তিনি তার বন্ধুদের কাছে ট্রেনের গতি আর আরামের গল্প এত উৎসাহে বললেন যে তারা সবাই ট্রেনে চড়তে উৎসাহী হয়ে উঠল!
একটু ইতিহাস, যেটুকু জানা দরকার
১৮৫৩ সালে বোম্বে থেকে থানে প্রথম ট্রেন চলে, তিনটি স্টিম ইঞ্জিন (সিন্ধু, সুলতান, সাহিব) ১৪টি কামরা টেনে নিয়ে যায়। প্রায় ৪০০ যাত্রী নিয়ে দুপুর ৩:৩৫ মিনিটে ট্রেন ছাড়ে আর ৫৭ মিনিটে থানে পৌঁছায়। ব্রিটিশরা বাণিজ্যের জন্য এই রেলপথ বানায়, কিন্তু এটি ভারতের পরিবহন, অর্থনীতি, আর সমাজকে বদলে দেয়। এই ছোট্ট যাত্রা আজকের বিশাল ভারতীয় রেলের প্রথম পদক্ষেপ ছিল।
হাসির শেষে
এই গল্পগুলো শুধু হাসির নয়, এগুলো সেই সময়ের মানুষের বিস্ময় আর কৌতূহলের ছবি। ট্রেন তাদের কাছে ছিল জাদু, দেবতার রথ, কিংবা উড়ন্ত গাড়ি। গোপালের দৌড় থেকে পুরোহিতের পূজা—প্রতিটি গল্প আমাদের ফিরিয়ে নিয়ে যায় ১৮৫৩-এর সেই উত্তেজনাময় দিনে। তাই পরের বার ট্রেনে চড়লে একটু ভেবে দেখবেন, এই লোহার পথের শুরুটা কত হাসি, ভয়, আর আনন্দে ভরা ছিল!