মেয়র পদে ২০ বছর আলাস্কার বিড়াল স্টাবস

আপনি কি কখনো শুনেছেন এমন এক শহরের গল্প, যেখানে মেয়রের চেয়ারে বসে আছে একটি কমলা রঙের বিড়াল? হ্যাঁ, ঠিকই শুনেছেন! আলাস্কার ছোট্ট শহর টালকিটনার এই গল্প শুধু মজারই নয়, এটি হৃদয় ছুঁয়ে যায় এবং প্রমাণ করে যে কখনো কখনো সবচেয়ে অপ্রত্যাশিত প্রাণীটিই একটি সম্প্রদায়ের প্রাণ হয়ে উঠতে পারে। চলুন, জেনে নেওয়া যাক স্টাবস নামের এই বিড়ালের অসাধারণ গল্পে, যে ২০ বছর ধরে একটি শহরের "মেয়র" ছিল!


একটি বিড়ালছানা থেকে শহরের নেতা

১৯৯৭ সালের কথা। আলাস্কার টালকিটনা, একটি ছোট্ট শহর যেখানে মাত্র ৯০০ জন মানুষ বাস করে। এই শহরের রাস্তায় তুষারের আস্তরণ আর চারপাশে পাহাড়ের অপরূপ সৌন্দর্য। কিন্তু সেই বছর, শহরের মানুষ তাদের মেয়ের নির্বাচন নিয়ে অসন্তুষ্ট ছিল। কারণ কিছুতেই মেয়র নির্বাচনের প্রার্থীরা তাদের মনে ধরছে না। তখনই ঘটলো এক মজার ঘটনা। লরি স্টেক, যিনি শহরের জনপ্রিয় Nagley's General Store পরিচালনা করতেন, মজা করে বলে উঠলেন, “আমাদের মেয়র হওয়া উচিত আমার বিড়াল স্টাবস-এর।” স্টাবস তখন ছিল  কচি বিড়ালছানা, কমলা রঙের লোম আর দুষ্টু দুষ্টু চোখ নিয়ে দোকানের চারপাশে লাফালাফি করে বেড়াতো। শহরের মানুষ এই প্রস্তাব শুনে হেসে গড়িয়ে পড়ল, কিন্তু তারপরই ভাবল, “কেন নয়?” ফলাফল? স্টাবস সর্বসম্মতিক্রমে টালকিটনার মানদ মেয়র নির্বাচিত হলো!


মেয়র স্টাবসের দিনরাত

স্টাবসের মেয়র হওয়ার কথা শুনলে হয়তো ভাবছেন, একটা বিড়াল কীভাবে শহর চালাবে? আসলে, স্টাবসের কাজ ছিল শহরের মানুষের মুখে হাসি ফোটানো আর পর্যটকদের মন জয় করা। তার “অফিস” ছিল Nagley's General Store, যেখানে তার জন্য একটি নরম বিছানা আর একটি ছোট্ট ঝুড়ি রাখা হতো। দিনের বেশিরভাগ সময় সে দোকানের চারপাশে ঘুরে বেড়াত, পর্যটকদের সঙ্গে “মিটিং” করত (অর্থাৎ তাদের পায়ে গা ঘষত!)। আর একটি মজার ব্যাপার ছিল স্টাবসের পানীয়। সে জল পান করত না—তার জন্য বিশেষভাবে তৈরি করা হতো ক্যাটনিপ মিশ্রিত তরল, যা একটি ছোট গ্লাসে পরিবেশন করা হতো। পর্যটকরা এই দৃশ্য দেখে খুব খুশি হতো। স্টাবসের এই ছোট ছোট অভ্যাস তাকে শহরের সবচেয়ে প্রিয় ব্যক্তিত্ব বানিয়ে তুলেছিল। 


বিশ্বজুড়ে স্টাবসের খ্যাতিস্টাবসের গল্প কিন্তু শুধু টালকিটনাতেই সীমাবদ্ধ থাকেনি। ধীরে ধীরে তার খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ল বিশ্বজুড়ে। CNN, BBC, এমনকি জাপানের সংবাদপত্রেও তার গল্প প্রকাশিত হলো। তার ফেসবুক পেজে হাজার হাজার ফলোয়ার জমা হলো, যারা তার দৈনন্দিন কার্যকলাপের আপডেট দেখত।২০১২ সালে, স্টাবস আবার “নির্বাচিত” হয়। শহরের মানুষ তার পক্ষে পোস্টার বানিয়েছিল, যেখানে লেখা ছিল, “Stubbs for Mayor: Purr-fect Leadership!”। মজার ব্যাপার হলো, স্থানীয়রা বলত, “স্টাবস আমাদের সবচেয়ে সৎ মেয়র, কারণ সে কখনো মিথ্যা বলে না!” এই হাস্যরস আর স্টাবসের মিষ্টি মুখ শহরটিকে পর্যটকদের কাছে আরও আকর্ষণীয় করে তুলল।


বিপদের মুখোমুখি

২০১৩ সালে, স্টাবসের জীবনে এলো একটি নাটকীয় মুহূর্ত। একদিন রাতে, একটি কুকুর তাকে আক্রমণ করে, এবং সকলের প্রিয় মেয়র গুরুতর আহত হয়। তার ফুসফুস ক্ষতিগ্রস্ত হয়, পাঁজর ভেঙে যায়। টালকিটনার মানুষ শোকে মুহ্যমান। কিন্তু স্টাবস ছিল একজন যোদ্ধা! সে ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে উঠল, এবং তার ফিরে আসার খবরে শহরে উৎসবের আমেজ ফিরে এল। এই ঘটনা স্টাবসকে আরও কিংবদন্তি বানিয়ে দিল।


স্টাবসের বিদায় এবং তার উত্তরাধিকার

দুর্ভাগ্যবশত, ২০১৭ সালের ২১ জুলাই, ২০ বছর বয়সে স্টাবস চিরবিদায় নিল। তার মৃত্যুর খবরে টালকিটনার প্রতিটি ঘরে শোকের ছায়া নেমে এল। বিশ্বজুড়ে তার ভক্তরা সোশ্যাল মিডিয়ায় শ্রদ্ধা জানাল। Nagley's General Store-এ তার স্মরণে একটি বিশেষ কোণ তৈরি করা হলো, যেখানে তার ছবি আর স্মৃতিচিহ্ন রাখা আছে। 

স্টাবসের পরে টালকিটনা আর কোনো বিড়ালকে মেয়র বানায়নি, কিন্তু তার গল্প আজও শহরের পরিচয়ের একটি অংশ। পর্যটকরা এখনো Nagley's Store-এ গিয়ে স্টাবসের গল্প শোনে, তার ছবি কেনে, আর হাসিমুখে বলে, “এই শহরে একটা বিড়ালই সবচেয়ে ভালো শাসক ছিল!”


কেন স্টাবসের গল্প আমাদের মুগ্ধ করে?

স্টাবসের গল্প শুধু একটি বিড়ালের গল্প নয়। এটি একটি ছোট শহরের সৃজনশীলতা, হাস্যরস, আর ঐক্যের গল্প। একটি বিড়াল কীভাবে একটি সম্প্রদায়ের প্রাণ হয়ে উঠতে পারে, সেটি স্টাবস সবাইকে দেখিয়েছে। তার দুষ্টু হাসি, ক্যাটনিপ তরলের অভ্যাস, আর শহরের মানুষের ভালোবাসা—এসব মিলে স্টাবস হয়ে উঠেছে একটি কিংবদন্তি।


এখন আপনি যদি আলাস্কায় ঘুরতে যান, টালকিটনা শহরটায় একটু ঘুরে আসবেন। Nagley's Store-এ পা রাখলেই হয়তো স্টাবসের সেই মিষ্টি উপস্থিতি আপনাকে স্বাগত জানাবে। আর যদি কখনো মনে হয় জীবনটা একটু বেশি গম্ভীর হয়ে যাচ্ছে, তাহলে স্টাবসের গল্পটা মনে করবেন—একটা বিড়ালও পারে পৃথিবীকে হাসিতে ভরিয়ে দিতে!

Popular posts from this blog

ক্যালেন্ডারের কারসাজি: যেদিন সময় চুরি হলো আর হাসির হাট বসল!

লোহার দৈত্যের মজার গল্প: ভারতের প্রথম ট্রেন